বিশ্ব বাঘ দিবসের প্রাক্কালে নতুন গবেষণা বাংলাদেশকে বাঘ চোরাচালান ও পাচারের অন্যতম প্রধান দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে

Tiger
©STEVE WINTER

দেশে এবং বিদেশে, ক্রমবর্ধমান নব্য বাংলাদেশী ধনী শ্রেণীর চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশ, ভারত এবং মায়ানমার থেকে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এর চাপ বাড়তেছে

গবেষকেরা দেশের "জলদস্যু শিকারী" নেটওয়ার্ক ভেঙে ফেলার প্রশংসা করেছেন, তবে নতুন আবর্তিত বিষ দিয়ে শিকার বন্ধের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন

মিডিয়া যোগাযোগ: সুসি ওয়েলার শেপার্ড, sweller@panthera.org, 347-446-9904

Read this Press Release in English here.

View photos and videos.

নিউইয়র্ক, N Y — আন্তর্জাতিক বাঘ দিবসের সময়ে, বৈশ্বিক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা প্যান্থেরা এবং চাইনিজ একাডেমি অফ সায়েন্সেস এর নতুন গবেষণা বাংলাদেশকে বিপন্ন বাঘের অবৈধ চোরাচালান ও পাচারের একটি  প্রধান কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পূর্বের অনুসন্ধানের বিপরীতে, দেশে এবং বিদেশে ক্রমবর্ধমান বাংলাদেশী অভিজাত শ্রেণীর সাম্প্রতিক চাহিদাকে  বাংলাদেশের সুন্দরবন, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং উত্তর মায়ানমার অঞ্চলে বাঘ শিকার ও চোরাচালানের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিনহিত করেছে।

বর্তমানে অবৈধ বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভোক্তা এবং উৎস হিসেবে চিহ্নিত বাংলাদেশ আগামী দশকে বাঘ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বারোটি স্বতন্ত্র বাঘ শিকার ও পাচার সম্পর্কিত সমস্যা চিহ্নিত করেছেন এবং প্রতিটি সমস্যা সমাধানের জন্য প্রসঙ্গ-উপযুক্ত পদ্ধতি প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন।

কনজারভেশন সাইন্স ও প্র্যাকটিস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় বাংলাদেশের বাহিরে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের  গন্তব্যস্থান গুলিকে সুনির্দিস্ট করা হয়েছে যা আগে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বাঘ সংরক্ষণের সাথে জড়িত সংস্থাগুলির জানা ছিল না। গবেষণায় দেখা যায় বাংলাদেশে এবং দেশের বাহিরে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিসহ মোট ১৫টি দেশে বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাচার হয়। আর বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের চাহিদার নেতৃত্ব দেয় ভারত, চীন এবং মালয়েশিয়া, এই কাতারে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের মত G20 ভুক্ত দেশগুলিও রয়েছে।

প্যানথেরার কাউন্টার-ওয়াইল্ডলাইফ ক্রাইম রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকসের দলনেতা এবং এই গবেষণার সহযোগী লেখক  ড.  রব পিকলস বলেন, “এই গবেষণাটি দেখায় যে বাংলাদেশ বাঘের অবৈধ ব্যবসায় আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবং একই সাথে এই গবেষণা কিছু আশারও জন্ম দেয়।"

পিকলস আরও বলেন, “ এই গবেষণা বাংলাদেশে  অবৈধ বাঘের ব্যবসা সম্পর্কিত জটিলতা ভেঙ্গে এখন আমাদেরকে কাজ করার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য দিয়েছে, এবং অবৈদ শিকার নিয়ন্ত্রণে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশের জলদস্যু নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থার সফলতা, বর্তমানে বাঘ শিকার এবং পাচারকারী গোষ্ঠীগুলিকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য একটি সফল উদাহরণ হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।"

জোয়ার-ভাটার অন্যতম প্রধান বন বাংলাদেশের সুন্দরবনের চ্যানেলগুলি ২০০০ সাল থেকে শুরু করে ২০১৮  সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০ টি জলদস্যু নিয়ন্ত্রণ করত।  চাঁদাবাজি, অপহরণ, বনজীবিদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় ইত্যাদি তাদের নিত্যনইমত্তিক কাজ ছিল। তাদের মধ্যে অন্তত সাতটি জলদস্যু দল প্রত্যক্ষ ভাবে বাঘ শিকারে অংশ নেয় এবং বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চোরাচালানে আধিপত্য বিস্তার করে। ফলস্বরূপ, সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা যা ২০০৯ সালে ৩০০-৫০০ ছিল তা ২০১৮ সালে ৫০%-এরও বেশি কমেছে এবং আনুমানিক ১১৪ তে  নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ সরকারের ২০১৬ সালের জলদস্যুতা প্রতিরোধ অভিযান জলদস্যু গোষ্ঠীগুলিকে সাধারণ ক্ষমার প্রস্তাব দেয়, যারা প্রত্যাখ্যান করে তাদের লক্ষ্য করে  অভিযান পরিচালনা করা হয়। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যে অঞ্চলটিকে জলদস্যুমুক্ত ঘোষণা কর হয়। তবে জলদস্যু চলে যাওয়ার পর তাদের শূন্যস্থান দখল করেছে প্রায়  ৩২ টি বিশেষজ্ঞ বাঘ চোরাচালানকারী সিন্ডিকেট এবং তারা কৃষি কাজে ব্যবহৃত প্রধান বিষ ফুরাডন ব্যবহার করে বাঘ হত্যা করে থাকে।

গবেষক দলের প্রধান এবং চাইনিজ একাডেমি অফ সায়েন্সের প্রাক্তন ডক্টরাল ফেলো, ড. নাসির উদ্দিন, ২০১৬-২০২১ সাল পর্যন্ত বাঘ চোরাচালানের তত্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করেছেন এবং স্থল, সমুদ্র এবং আকাশপথে বাংলাদেশে বাঘ পাচারের সাথে জড়িত প্রায় ১৬৩ চোরা শিকারী, চোরাকারবারী এবং ব্যবসায়ীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তিনি বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহের স্থান, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিতরণ কেন্দ্র, ট্রানজিট পোর্ট, অবৈদ সীমান্ত ক্রসিং এবং ব্যবহারের স্থান সহ বাণিজ্য রুটগুলি চিহ্নিত করেছেন।

গবেষকরা চারটি উৎসস্থল শনাক্ত করেছেন যেখান থেকে বাঘ শিকার করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশ জুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন, ভারতের কাজিরাঙ্গা-গরমপানি পার্ক, মায়ানমারের নর্দার্ন ফরেস্ট কমপ্লেক্স এবং ভারতের নামদাফা-রয়্যাল মানস পার্ক। ব্যবসায়ীরা প্রায়শই বিভিন্ন কোম্পানির নামে বাঘের চোরাচালানের সাথে জড়িত, এবং কিছু ক্ষেত্রে বৈধ বন্যপ্রাণী ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণীর ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। বাংলাদেশ থেকে বাঘ চোরাচালানের সিংহভাগই ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে স্থল সীমান্ত দিয়ে হয়। আঞ্চলিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, এবং দেশগুলির মধ্যে সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত মিল বাঘ চোরাচালানে অন্যতম সহায়ক হিসেবে কাহ করে, এবং বাঘের অংশ পাচারকারী চক্রগুলি মাদক পাচার করতেও দেখা গেছে।

বর্তমান বাঘের পাচার রোধ করার জন্য বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশ সরকারকে একটি প্রব্লেম ওরিয়েন্টেড পন্থা অবলম্বন করতে উত্সাহিত করছেন যা শিকার নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গুলোর সাথে প্রধান পাচারকারীদের সনাক্ত, বাণিজ্যিক রুট চিনহিত করতে  এবং তাদের নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা যেতে পারে। গবেষকরা স্থল, সমুদ্র এবং আকাশ পথে চোরাচালান সনাক্তকরণ বৃদ্ধি; ঘুষ হ্রাস; এবং দোষী সাব্যস্ত ও সক্রিয় অপরাধীর সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বাঘ সংরক্ষনে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ গুলোর নিয়মিত  মূল্যায়নেরও পরামর্শ দেন। যে সকল সীমান্ত দিয়ে বাঘের চোরাচালান হয় সে সকল সীমান্তের লকজনকে সম্পৃক্ত করাও গুরুত্বপুর্ন বলে এই গবেষণা মত প্রদান করেন। একি সাথে ধনী লোকজনের বাঘের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার এবং ব্যবহারের কারণ নিয়ে গবেষণাও  দেশের চোরাশিকার বিরোধী অভিযানে সহায়তা করবে।

গবেষণার সহ-লেখক এবং প্যানথেরা টাইগার প্রোগ্রামের পরিচালক, ডঃ অভিষেক হারিহার, বলেছেন, “দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে বাঘ শিকারের জন্য গ্রাউন্ড জিরো হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, কিন্তু এই গবেষণাটি দেখায় যে শিকার এখনও  বাঘের জন্য সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হুমকি। চীন এবং ভিয়েতনামের বাইরে বাঘের চোরাচালানের প্রভাব এখানে সমান না হলেও, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিজ্ঞানীদের অবশ্যই মনোযোগী হতে হবে, কারণ বাংলাদেশে অবৈধ বাঘ পাচারের জন্য সুবিধাজনক অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।"

বাংলাদেশে বাঘের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহারের একটি গভীর ও দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য রয়েছে।  ধনী বাংলাদেশী নাগরিকরা ঔষধি কাজে, আধ্যাত্মিক উপাদান হিসেবে এবং শোভাকর উদ্দেশ্যে বাঘের অংশ বিশেষ যেমন হাড়, কর্তন দাঁত, মাংস, দুধ, মাথার খুলি, চামড়া ইত্যাদি ব্যবহার করেন যার সমগ্রিক মূল্য প্রায় ১৭,৪৫০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।  অনেক ক্ষেত্রে দৈহিক শক্তি বাড়াতে মাংস খাওয়া হয়; কর্তন দাঁত এবং নখরগুলিকে শক্তির প্রতীক হিসাবে এবং  খারাপ আত্মাকে তাড়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়; মাথার খুলি এবং চামড়া স্ট্যাটাস সিম্বল এবং নিয়োগকর্তাদের কাছে প্রমোশনের জন্য উপহার হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

২০২২ সালে প্যান্থেরার নেতৃত্বাধীন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার'স (IUCN)  রেড লিস্ট গত সাত বছরে বাঘের সংখ্যা সম্ভাব্য 40% বৃদ্ধি পেয়েছে বলে রিপোর্ট করে, যা ২০১৫ সালে ৩,২০০ থেকে ২০২২ সালে ৪,৫০০ হয়েছে৷ তারপরও, বিজ্ঞানীরা আশাবাদী হিসাবে সতর্ক অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷ কোন কারণে বাংলাদেশে বাঘের বিলুপ্তি  বিশ্বব্যাপী বিপন্ন বাঘের জনসংখ্যার জিনগত বৈচিত্র্য দৃঢ়ভাবে হ্রাস করবে।

সাতটি বাঘ সমৃদ্ধ দেশে সক্রিয় প্যানথেরার টাইগারস ফরএভার প্রোগ্রামের লক্ষ্য দশ বছরে বাঘের সংখ্যা কমপক্ষে 50% বৃদ্ধি করা। বাঘ সংরক্ষণে প্রধান হুমকি মোকাবেলা করার জন্য - শিকার এবং বাসস্থানের ক্ষতি কমানোর জন্য - প্রোগ্রামটি সুরক্ষিত এলাকাগুলিকে আরও  সুরক্ষিত করার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং উপকরণ প্রদানের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে; এর পাশাপাশি বাঘের এবং শিকারের বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ পরিচালনা করা; এবং বাঘের আবাসস্থলকে সংযুক্ত ও রক্ষা করাও এই প্রোগ্রামের অন্যতম প্রদান কাজ।

এই সমীক্ষাটি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে বাঘের চোরাচালানেরর  সবচেয়ে সুনির্দিষ্ট ধারণা প্রদান করে, এর সাথে অন্য গবেষণা যেমন বাঘ চোরাচালানকারী ব্যবসায়ী  এবং অপরাধীর প্রতিস্থাপন, জীবন্ত বিড়াল গুত্রের  বন্যপ্রাণী পাচার  এবং বাংলাদেশে বাজার ভিত্তিক বন্যপ্রাণী বেচাকেনা পর্যালোচনা ইত্যাদি গবেষণাও এই গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলকে সমৃদ্ধ করে।

Tiger infographic